ডেঙ্গুতে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা

জেলা প্রতিবেদক,  ঈশ্বরদী (পাবনা):  বাড়ি থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে তুষার আলীর (২৫) কবর। গত ১৮ নভেম্বর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান তুষার। মৃত্যুর পর এখনো থামেনি তুষারের মায়ের কান্না। কিছু সময় পরপর বাড়ির সামনে বসে ছেলের কবরের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন শামসুন্নাহার বেগম।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা শামসুন্নাহার। পরিচিত কেউ এলে তার কাছে ছেলের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর বর্ণনা দিতে দিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছুতেই যেন থামতে চায় না সে কান্না।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা শামসুন্নাহার। পরিচিত কেউ এলে তার কাছে ছেলের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর বর্ণনা দিতে দিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

পাবনার ঈশ্বরদী পৌর শহরের নারিচা এলাকার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে তুষার আলী। ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে রসায়ন বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের খরচ জোগাতে কাজ করতেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্টোরি টেক সিস্টেমায়।

সম্প্রতি তুষারের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বাইরে পুকুর পাড়ে তুষারের মা ও মামাসহ স্বজনরা বসে আছেন। তুষারের মা তাকিয়ে আছেন আদরের একমাত্র ছেলের কবরের দিকে। বাড়ি থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে ইসলামপুর নারিচা স্কুলপাড়া গোরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে তুষারের কবর।

কথা হয় তুষারের ফুফু রাশিদা খাতুনের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, তুষারের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০০৮ সালে। তখন তুষারের বয়স মাত্র পাঁচ-ছয় বছর। তার বড় বোন সুমাইয়া খাতুন স্মৃতি তুষারের চেয়ে এক বছরের বড়। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে মহাসংকটে পড়েন তুষারের মা। সেলাই মেশিনে টুকিটাকি কাজ করে খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন কাটছিল। তুষার কলেজে ভর্তির পর নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। মাঝে মধ্যে দিনমজুরের কাজও করতেন। এভাবেই কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

রাশিদা খাতুন জানান, পাঁচ বছর আগে তুষারের বোনের বিয়ে হয়েছে। এখন বয়সের ভারে তুষারের মা সেলাই মেশিনের কাজ করতে পারেন না। পড়াশোনার পাশাপাশি তুষার যা আয় করতেন তা দিয়ে চলতো সংসার। ছয় মাস আগে তুষার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন।

পাঁচ বছর আগে তুষারের বোনের বিয়ে হয়েছে। এখন বয়সের ভারে তুষারের মা সেলাই মেশিনের কাজ করতে পারেন না। পড়াশোনার পাশাপাশি তুষার যা আয় করতেন তা দিয়ে চলতো সংসার।

তুষারের মামা আব্দুল আওয়াল বলেন, ৩ নভেম্বর তুষারের কলেজে পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে তার মাকে জ্বর জ্বর অনুভূতির কথা জানান। পরদিন সকালে স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক দেখানো হয়। চিকিৎসক তাকে কয়েক ধরনের ওষুধ দেন। এতে জ্বর না কমায় ৭ নভেম্বর তুষারকে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রক্ত পরীক্ষা করে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। পরদিন ছুটি নিতে অফিসে যান তুষার। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পর জ্বর আরও বাড়ে। এরপর ৯ নভেম্বর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দুদিন চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে চিকিৎসকরা তাকে বাড়ি ফেরার পরামর্শ দেন। বাড়ি ফিরে আসার পরদিন আবার জ্বর আসে। এরপর তাকে আবারও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ১৬ নভেম্বর তুষারকে নেওয়া হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। ১৮ নভেম্বর দিনগত রাত ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

একমাত্র ভাইকে হারিয়ে নির্বাক তুষারের বোন সুরাইয়া ইয়াসমিন স্মৃতি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘পরিবারে উপার্জন করার মতো আর কেউ রইলো না। ছোটবেলা থেকে দুই ভাই-বোন অর্থকষ্টে বড় হয়েছি। আমার বিয়ে হয়েছে। ভেবেছিলাম তুষার পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করে পরিবারের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাবে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি।’

নারিচা মশুড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম আজম বলেন, তুষার মেধাবী ছাত্র ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে টিউশনি ও দিনমজুরি করে সংসার এবং নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতো। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে তার মা এখন বাকরুদ্ধ।

ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শফিকুল ইসলাম শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ৭ নভেম্বর তুষার ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এলে তার রক্ত পরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাড়ি চলে যান। দুদিন পর অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তুষার মারা যান।

Related Articles

Back to top button