অবরোধ কর্মসূচি পালন করছিলেন শিক্ষার্থীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক :কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। ১৯ জুলাই শুক্রবার বাড্ডা ও রামপুরা এলাকা থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলাম। পরে আরও কয়েক দিন একই এলাকার সংবাদ সংগ্রহ করেছি।

আগের দিন ১৮ জুলাই সকাল থেকে রাজধানীর বাড্ডা ও রাস্তায় নেমে আসেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে বাধ্য করার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে গতি ধরে রাখেন। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধের মুখে পুলিশ সদস্যরা কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে অবস্থান নেন। বেলা আড়াইটার দিকে র্যাবের হেলিকপ্টার এসে তাঁদের উদ্ধার করে। সব মিলিয়ে বাড্ডা–রামপুরা হয়ে ওঠে আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রস্থল।

এরই মধ্যে শুক্রবার দিবাগত রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি করা হলো। বন্ধ করে দেওয়া হলো ইন্টারনেট সেবাও। কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামবেন, এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। কারফিউর প্রথম দিন ২০ জুলাই তাই সংবাদ সংগ্রহ করতে সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হলাম। মনের ভেতর অজানা ভয় কাজ করছিল। আমার বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে মেরুল বাড্ডার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। হেঁটে যখন ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। মূল সড়কে আসতেই দেখি, গুলিতে রক্তাক্ত এক শিক্ষার্থীকে ধরাধরি করে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সহপাঠীরা। রিকশায় রক্তের দাগ লেগে আছে।

সেই রিকশার পিছু নিয়ে এইমস হাসপাতালের সামনে গেলাম। সেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা রামপুরা ব্রিজের ওপর থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছেন। সেই গুলি এসে কারও মাথায়, কারও পায়ে লাগছে। তাঁদের সঙ্গে কথা শেষ করে অফিসে মুঠোফোন সংবাদ দিলাম। যখনই গুলির শব্দ শুনি, দেখি আন্দোলনকারীরা দৌড়ে গলিতে ঢুকে পড়ছেন। তাঁদের সঙ্গে আমি গলির মুখে গিয়ে দাঁড়াই। প্রতিটি গুলির শব্দের পর কেউ না কেউ আহত হচ্ছেন, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে ছুটছেন অন্যরা। এভাবে সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেখলাম অন্তত ১০ জনকে গুলিবিদ্ধ হতে। এরপর গোলাগুলি থেমে গেল।

দুই সাংবাদিক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার ফুটপাত ধরে রামপুরা ব্রিজের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এতক্ষণ পরিচয়পত্র পকেটে লুকিয়ে রেখেছিলাম। সেটা বের করে গলায় পরলাম। ব্রিজের ওপরে আসতেই দেখি, বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্য বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমরা ব্রিজের পাশে থাকা ট্রাফিক পুলিশের ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।

আমাকে দেখে এক পরিচিত পুলিশ সদস্য এগিয়ে এলেন। আমাকে সাবধান করে বললেন, ‘সরাসরি গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাউকে আর মূল সড়কে আসতে দেওয়া হবে না। আন্দোলনকারী দেখলেই গুলি করা হবে।’ পুলিশ সদস্যের এ কথায় বুঝলাম, পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর দিকে এগোচ্ছে।

একজন পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে পুলিশের দলটি সরে গেল। এর কিছুক্ষণ পর বনশ্রী আবাসিক এলাকার ভেতর থেকে আন্দোলনকারীরা একটি মিছিল নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ফটকের সামনে এসে অবস্থান নিল। বেলা একটার দিকে সেখান থেকে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করলেন আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে রামপুরা ব্রিজে দাঁড়িয়ে পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি ছুড়লেন। পরে বিজিবি সদস্যরা এগিয়ে গেলেন। তাঁরাও গুলি শুরু করলেন। এর আধা ঘণ্টা পরে আমার কাছে খবর এল, রামপুরার একটি হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ দুজনকে ভর্তি করা হয়েছে। একজন মারা গেছেন। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ব্রিজের তিন পাশ থেকে আন্দোলনকারীরা আবার রাস্তায় নেমে এলেন।

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা হাতিরঝিলের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তখন আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা গেল। এর কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়া শুরু হলো। আমি হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে আবার বাড্ডায় চলে এলাম। তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি গুলি এসে আমার শরীরে লাগবে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরেও গুলির শব্দ শুনছিলাম। সেদিন বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে কতজন আন্দোলনকারী আহত-নিহত হলেন, তার সঠিক হিসাব নিতে পারলাম না।

পরদিন ২১ জুলাই সকালে মেরুল বাড্ডায় আমার বাসা থেকে বের হলাম। মূল সড়কে যেতে পারলাম না। গলির মুখে দাঁড়িয়ে পুলিশ গুলি করছে। এর পরের দিনগুলো কখনো রামপুরা–বাড্ডা, কখনো রাজধানীর অন্যান্য জায়গা ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করতে থাকলাম।

এভাবেই চলে এল ৫ আগস্ট। সেদিনও সকাল থেকে বাড্ডা এলাকায় ছিলাম সংবাদ সংগ্রহের জন্য। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত পুলিশকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছুড়তে দেখলাম। পরে মানুষের ঢল দেখে পুলিশ বাড্ডা থানার ভেতরে গিয়ে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। তারপরও পুলিশ গুলি ছুড়েছে। বিকেল চারটা থেকে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী বাড্ডা থানা ঘিরে রাখলেন।

পরদিন ৬ আগস্ট সকালে গিয়ে দেখলাম, থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। থানা থেকে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। আমি মুঠোফোনে ছবি তুলে তথ্য নিয়ে কারওয়ান বাজারে অফিসে চলে গেলাম।

আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে মিছিল, হামলা, গুলি, হতাহত, কান্না, ছোটাছুটি ছিল প্রতিদিনের চিত্র। বাসা থেকে প্রতিদিন সকালে বের হতাম। ফোনে তথ্য দিতাম, অফিসে থাকা কোনো সহকর্মী সেই তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতেন। রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরতাম। পরের দিন কী হবে, সেই চিন্তায় অনেক রাত আমার নির্ঘুম কেটেছে। অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক হওয়ায় আগেও আন্দোলন ও সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহে মাঠে থেকেছি; কিন্তু এত ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আগে কখনো যাইনি। জানি না সাংবাদিক হিসেবে আর কখনো এমন ভয়ংকর কোনো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে কি না!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button